Raghab_Bandyopadhay

Raghab was born on 14 November 1948 at Bhawanipore in Kolkata, one year after India’s Independence. That way he can be called a Midnight’s child. Brought up in north Kolkata, he came in touch with rural Bengal in the late 60s by virtue of his close association with the Naxalite movement. About this time he started writing. In 1970, he was arrested and spent three years in jail. This experience was reflected in his first novel, কমুনিস. The publication of Komunis got an encouraging reaction from intellectuals including Ashok Rudra and Malini Bhattacharya. In the late 1970s and in 1980s, Raghab Bandyopadhyay continued publishing. His works of the period include বাদার গল্প, a collection of short stories, and his second novel শৈশব. During this time Raghab also began his career as a professional journalist. Since his retirement in 2007 he has been heading a publishing house named Charchapada Publication Private Limited. He also edits a half-yearly Bengali magazine called চর্চা alongside.


Collection of stories

  1. অকালবোধন ও অন্যান্য গল্প
  2. বাদার গল্প
  3. অংশগ্রহণ
  4. গল্প ৩৩
  5. আশমানি কথা: উচ্ছেদের পাঁচ কহন
  6. গল্প সংগ্রহ

Novels

  1. কমুনিস
  2. শৈশব
  3. তাহারা
  4. মুদ্রণ সৌন্দর্য
  5. শহর সংস্করণ
  6. সটীক জাদুনগর
  7. চোর চল্লিশা
  8. মেধাবী ভূত ও মাধবীলতা
  9. অপারেশন রাজারহাট

Contribution in edited volumes

  1. Memory’s Gold, Writings on Calcutta, edited by Amit Chaudhuri, Penguin Viking, 2008.
  2. Calcutta The Living City, Vol:2, edited by Sukanta Chaudhuri, Oxford University Press, 1990.

Essays

  1. কমলকুমার ও কলকাতা: পিছুটানের ইতিহাস
  2. মার্জিনের লেখা লেখার মার্জিনে

Journalistic and other writings

  1. বাংলার মুখ
  2. বাবু বিবি ও তাহারা
  3. প্রান্তজনের কথা
  4. জার্নাল সত্তর

Interviews

  1. তথ্য, অখ্যান, প্রবন্ধের কোলাজ : অপারেশন রাজারহাট

Special issue on Raghab Bandyopadhyay

১) ভাবনগর – Bhabnagar – Chicago Lecture
২) কথক, edited by Shatadal Mitra, January, 2012. Some of the contributors are Dipesh Chakrabarty, Ashok Sen, Debesh Roy, Hiran Mitra, Swapan Chakrabarty, Pradip Basu, Sanjoy Mukhopadhyay, Sumita Chakrabarty, Ranabir Lahiri, Nabarun Bhattacharya, Debarshi Talukdar.


Media


A tribute to Raghab Bandyopadhyay – Tritiyo Parisar (তৃতীয় পরিসর)


স্বাধীনতার সমসাময়িক এই লেখকের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে। বাবা মণীন্দ্রনাথ ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অতি শৈশবে পিতৃহীন রাঘবের ছোটোবেলা কেটেছে মা অন্নপূর্ণা ও দিদি বন্দনার সঙ্গে, উত্তর-পূর্ব কলকাতা আর তার সন্নিহিত অঞ্চলে বার বার বাসা বদল করে। উজ্জ্বল মহানগরীর প্রান্তে বেঁচে থাকা মানুষদের সঙ্গে তখন থেকেই গড়ে উঠেছে নিবিড় পরিচয়। স্কুলের পড়াশুনো প্রথমে টাউন স্কুল ও পরে নারকেলডাঙা হাই স্কুলে। কলেজজীবনের গোড়ার দিকেই নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ফলে রাজনৈতিক জীবনের শুরু ও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনোর ইতি প্রায় এক ই সময়ে। রাজনীতির সূত্রে জেল খাটতে হয়েছে বছর দুয়েক। যে প্রশ্ন আর অণ্বেষণ নকশাল আন্দোলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে, তা-ই আবার সক্রিয় রাজনীতির পরিসরের বাইরে ঠেলে দিয়েছে তাঁকে। জনজীবন ও রাজনীতি সম্পর্কে উত্সাহে কোনো ভাঁটা না পড়লেও বেছে নিলেন একার কাজ লেখালিখিকেই। ১৯৬৭-৬৮ সালে কলেজে পড়ার সময়ে লিটল ম্যাগাজিনে গল্প লেখা দিয়ে শুরু হলেও এ বিষয়ে সিরিয়াস ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে। প্রথম বই “অকালবোধন ও অন্যান্য গল্প” প্রকাশ পায় ১৯৭৪ সালে। সেই বছরেই বিয়ে হয় বিশাখার সঙ্গে। ১৯৮০ সালে জন্ম হয় মেয়ে যোগীয়ার। নিজের লেখালিখির পাশাপাশি এক-এক সময় এক-এক রকম কাজ করেছেন জীবিকার সূত্রে – মার্কেট রিসার্চের ফিল্ডওয়ার্ক, অনুবাদ, গবেষণা সংস্থায় রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ, কিছুদিন গৌরকিশোর ঘোষের অধীনে সাংবাদিকতা এবং তার পরে আনন্দবাজার পত্রিকায় স্থায়ী চাকরি। বাংলা ভাষার নিরলস চর্চা, তাকে শুধু সাহিত্যের নয় তত্ত্বচিন্তার ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রকল্প ও স্বপ্নের শিকড় ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত, রাঘব চিরকালই তার একান্ত শরিক। ফলে প্রায় সারা জীবনই যুক্ত থেকেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে; বিশেষভাবে উল্লেখ্য যোগসূত্র ও চর্চা। ২০০৭ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে গড়ে তোলেন ‘চর্চাপদ’ প্রকাশনা। বাংলায় মনন ও চর্চার একটি মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার শেষ যে উদ্যোগের অংশীদার ছিলেন, তা ‘তৃতীয় পরিসর’।


গুরুচন্ডা৯ – ১৪ নভেম্বর ২০২০
সতীনাথের ‘জাগরী’ এবং রাঘবের ‘কমুনিস’ : স্বপন চক্রবর্তী

( তাঁর জন্মদিন, খুব কাকতালীয় ভাবেই শিশুদিবস বলে পরিচিত ক্যালেন্ডার তারিখে। তার সঙ্গে অসঙ্গতি রাখতেই সম্ভবত রাঘব, লেখক হিসেবে শিশুতোষ হয়ে ওঠেননি, কদাপি। রাঘব প্রায় সারা জীবনে যাকে বলে কলকে পাওয়া, তা পাননি, কোনও ধরনের প্রতিষ্ঠানের থেকেই। শেষ দিকে অ্যাকাডেমিয়ার এক মহলের স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন বটে, তবে তার পর আর বেশিদিন বাঁচেননি। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে চর্চা হয় না, হওয়া উচিত ছিল, এ ধরনের একটা হা-হুতাশ কান পাতলে শোনা যায়, যদিও তা ফিসফিসানি। তবে তা ওই ফিসফিসানি অবধিই। এসব হুতাশ যাঁরা করে থাকেন, তাঁরাও রাঘব চর্চা করতে বললে ফেল মেরে যান, এমন প্রমাণাদি বিদ্যমান। তবু রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় এই দিনটাতে জন্মেছিলেন, তাঁকে নিয়ে একটা সংখ্যা করা গেল। লিখলেন যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী, তৃতীয় পরিসরের সম্পাদক সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এই্ প্রজন্মের ছাত্র পারভিন হোসেন।  )

raghab_satinath

রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি আমাদের সময়কার একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক ব’লে মনে করি। এর কারণ একাধিক, অল্প জায়গার মধ্যে বোঝানো দুষ্কর, অন্তত আমার মতো অপটু রসিকের পক্ষে। নিজের সুবিধের জন্যে শুরু করি সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রসঙ্গ দিয়ে। সতীনাথ যে বাংলা সাহিত্যের একজন বড়ো লেখক ছিলেন, সে বিষয়ে আজ বাঙালির সন্দেহ কম। সতীনাথ ছিলেন কংগ্রেস কর্মী, রাঘব ছিলেন মার্কসবাদী। অন্তত উত্তর-মার্কসবাদী তো বটেই। রাজনৈতিক বর্গ দিয়ে রাঘবের সাহিত্যবিচার সম্ভব নয়—কমলকুমার মজুমদারের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে তাঁর সংশয় তেমন সাক্ষ্যই দিচ্ছে। রাজনৈতিক গোষ্ঠীপরিচয়ের কথা হচ্ছে না, অনচ্ছ গদ্যের প্রবণতার কথা হচ্ছে। ‘আন্ধাইর রাত কাটে। চাকা চাকা করে। রাতের বুদ্‌বুদ ফাটিয়ে বেলেঘাটায় ভোর আসে ইনফর্মারের ছোঁকছোঁক চোখ ষড়যন্ত্রের আদিম অন্ধকার বুকের মধ্যে ছিপিয়ে।’ কমলকুমার যদি ভাষাতে অপরিচয়ের ব্যবধান সৃষ্টির এক দৃষ্টান্ত হ’ন, সতীনাথ রাজনৈতিক উপন্যাসের বহুস্বর সৃষ্টির এক দৃষ্টান্ত। সুতরাং রাঘবের কথা বলতে বসে অল্প হ’লেও সতীনাথের আলোচনা অবান্তর হবে না ব’লেই মনে হয়।

গত শতাব্দীর চারের দশকের থেকে আটের দশক পর্যন্ত এপার-বাংলায় যে-কয়েকটি মহৎ রাজনৈতিক উপন্যাস লেখা হয়েছে তাদের মধ্যে অসীম গুরুত্বের দুটি বই হ’ল সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ এবং রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কমুনিস’। ‘জাগরী’ ছিল সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম উপন্যাস, আর ‘কমুনিস’ রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘জাগরী’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে, স্বাধীনতার এক বছর আগে, এবং তার কাহিনির নেপথ্যে ছিল চার বছর আগেকার বিয়াল্লিশের সহিংস স্বাধীনতার লড়াই। ‘কমুনিস’ প্রথম বেরোয় ১৯৭৫ সালে, জরুরি অবস্থার জারির বছরটিতে, নকশালপন্থী শহর-গেরিলা হিসেবে লেখকের গ্রেফতারের পাঁচ বছর পরে, এবং তিন বছর জেল খাটার অন্তে। কারাগারে কংগ্রেস কর্মী সতীনাথকেও যেতে হয়েছিল—ভাগলপুর জেলে তাঁকে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে প্রায় চার বছর কাটাতে হয় দু-দফায়। ‘জাগরী’র ঘটনাকাল কারাগারে চরম প্রতীক্ষার একটি রাত। কিন্তু স্মৃতির প্রতিসরণ এবং চার মুখ্য চরিত্রের স্বগতচিন্তা বিস্তৃত করে তোলে তার আখ্যানপট, ব্যাপ্ত স্থানকালে বিচরণ করে কাহিনি। ‘কমুনিস’ সংকীর্ণ বিচারে কারাজীবন-কেন্দ্রিক নয়, যদিও সেখানেও ফাঁড়ি ও জেলখানার উপস্থিতি বিনিদ্র প্রহরায় নিয়োজিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মতোই সর্বত্র সদাপ্রবিষ্ট। দুটি উপন্যাস জুড়ে রয়েছে লেখকের নিজ নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা। গূঢ়তর মিল কিন্তু আছে অন্য জায়গায়। দুটি কাহিনিতেই স্মৃতি ও অন্তর্গত স্বগতকথনের মধ্যে রয়েছে চেতনাপ্রবাহের বাহ্য নির্মাণের চাইতেও আরও অস্বস্তিকর কিছু। ভাষার বিক্ষেপের মধ্যে ধরা আছে সেই অস্বস্তি। অস্বস্তি কথক বা বিপন্ন দিশেহারা চরিত্রগুলির যত না, তার চাইতে ঢের বেশি প্রতিটি উদ্দিষ্ট তথা নিরুদ্দিষ্ট পাঠকের। এমন বিক্ষত, কখনও-বা বিমূঢ়, পাঠ-অভিজ্ঞতা ও আত্মদীর্ণ জিজ্ঞাসা হল খাঁটি রাজনৈতিক উপন্যাসের জন্মদাগ—এ কথা বলা সাহিত্যবিচারের অবসন্ন শব্দগুচ্ছের অলস প্রয়োগ। যে কথা রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ ও ‘চার অধ্যায়’ সম্পর্কে খাটে, আবার তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’ কিংবা সতীনাথের ‘জাগরী’ সম্পর্কে সমান প্রাসঙ্গিক, যে কথা দীপেন্দ্রনাথের ‘শোকমিছিল’ কিংবা সমরেশের ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ সম্পর্কে বলা চলে, আবার শৈবাল মিত্রের ‘অগ্রবাহিনী’ কিংবা নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে অবান্তর নয়, সে কথা বলা নিরর্থক, হয়তো-বা অস্বস্তিটি এড়ানোর ফিকির। মননের এমন জড়তা প্রতিহত করাই নির্মম রাজনৈতিক উপন্যাসের স্বধর্ম। সপ্রশ্ন পাঠক সেখানে যুক্তি-প্রতিযুক্তির আগে থাকতে তৈরি কোনও উত্তর পান না, পান না সহজ সমন্বয়ের আরাম। রাজনৈতিক উপন্যাস, নৈতিক প্রতর্কের আলোচনার মতোই, খাড়া করে এক দুস্তর ভাষার বাধা, সুগম অর্থোদ্ধারের পথে এক কাঁটাতার। চেনা শত্রুকে চেনা ছকে শায়েস্তা করার কাহিনি চেনা ভাষায় পড়ে যাঁরা সুখ পান, মতাদর্শকে পালাবার সুড়ঙ্গ হিসেবে যাঁরা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, নিজের বিভ্রান্তির দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে স্লোগানসর্বস্ব গল্পের আশ্রয় খোঁজেন যাঁরা, সতীনাথ ভাদুড়ী ও রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় পড়তে তাঁদের আগ্রহ হওয়ার কথা নয়।

সতীনাথের গল্পে দুই ভাইয়ের গল্পে একজন ফাঁসির সাজার জন্যে প্রহর গুনতে থাকা কংগ্রেসের সমাজবাদী অংশের কর্মী, অন্যজন মার্কসবাদী, এবং একই জেলে বন্দি তাদের বাবা নির্ভেজাল গান্ধিবাদী। সতীনাথ নিজেও কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন সোশালিস্ট পার্টিতে ১৯৪৮ সালে, ‘জাগরী’ বেরোবার বছর তিনেক পরে। সংশয় রয়েছে ‘কমুনিস’ উপন্যাসের রাজনৈতিক পন্থা নিয়েও। উত্তর পান না পান, প্রশ্নগুলি আদতে প্রাঞ্জল আকারে যুবক গেরিলাদের রাগী অবিন্যস্ত চেতনায় স্পষ্টভাবে প্রকট হোক না হোক, রাঘবের উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র গোরা নিরন্তর সংশয়ে বিদ্ধ হয়েছে নকশালপন্থী আন্দোলনে খতম-পন্থার নেতাদের প্রভুত্ববাদ ও অপরিণামদর্শিতার নমুনা দেখে, মজুরদের আন্দোলনের রণকৌশলের সঙ্গে শহর-গেরিলাদের শ্রেণিসন্ত্রাসের গরমিল লক্ষ করে, তার রোজকার মাশুলের খুনে সাক্ষ্যে। ‘জাগরী’ চারজন এক পরিবারের কারা-কাহিনি: তাদের প্রত্যেকের পথ আলাদা, বিশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন, অথচ একই শ্রেণি ও সামাজিক পটভূমি তাদের দুঃসহ এক দূরত্বে বেঁধে রাখে, একই উদ্যানের নিঃসঙ্গ বৃক্ষরাজির মতো। রাঘবের উপন্যাসে মুখ্য চরিত্র গোরা বেলেঘাটার বস্তিতে আলাদা আলাদা জাতের, আলাদা আলাদা ভাষার, কর্মী ও মজুরদের মধ্যে এক শ্রেণিগত সংহতির প্রতিশ্রুতি দেখতে পায়, তাদের সুখেদুঃখে তার নিজের কমুনিস্ট শরিকি অধিকার খোঁজে এক ন্যায়ভিত্তিক সমাজের যৌথ স্বপ্নের মধ্যে। বেলেঘাটার বস্তি আর কারখানার সর্পিল গলিঘুঁজি এই জায়মান সামাজিক শরীরের ঐক্যের ছবি হয়ে ওঠে রাঘবের দেহঘন বাংলা-ভোজপুরী-ওড়িয়া মিশ্র বুলিতে, টাঙ্গি-আঁকড়ার মতো নিপীড়নের অমার্জিত হাতিয়ারের মতো শব্দ ঠেলে তাঁর গদ্য পাঁক আর রেললাইন ধরে ফেরারি আততায়ীর পায়ে-পায়ে হোঁচট খেতে খেতে এগোতে থাকে। লোহার গরাদ, তালা, ঘড়ি, চরকা, যুদ্ধের বাজারে জেলের যৎসামান্য তেল ও তৈজসপত্র, রাজনৈতিক শিবির অনুযায়ী কয়েদিদের ছোটো দল-উপদলের মার্কা—এগুলি ‘জাগরী’ উপন্যাসের এক-একটি প্রতীকী ফলক। ‘কমুনিস’-এ সেসবের জায়গা নেয় বেলেঘাটা-তপসিয়ার কারখানার সামনের পোস্টে ঝুলতে থাকা মলিন ঝান্ডা, ওয়ালিং-এর ‘টেনসিল’, মজুরদের ঝুপড়িতে বেহায়া রসুই-গোসল, কলকাতার জঞ্জালের শেষ ঠিকানা ধাপাপট্টি আর বেলেঘাটার পচাখাল, ছাল-ওঠা রাস্তার ওপর খড়ি-ওঠা পায়ের চোরাপথে হেঁটে চলার শব্দ, রেললাইন, মালগাড়ি, পুলিশ ভ্যানের হেডলাইট আর ব্রেকের শাসানি, আক্রান্তের পকেটে অসহায় ‘ওয়ান-শটার’, গেরিলা আস্তানায় অন্ধকারে জ্বলতে থাকা বিড়ি, মোমবাতি, জোড়া-জোড়া বিনিদ্র চোখ।

সংঘের শৃঙ্খলা আর কমরেডদের স্মৃতি-স্বপ্নের প্রতি দুর্মর ভালোবাসা—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে গোরার চিত্তবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির মধ্যে পদে পদে লাগে সংঘাত। পুলিশের বুটের সদম্ভ লাথ খেয়ে আর ছ-ঘরার ‘ক্যাপসুল’ বুকে নিয়ে নির্ভীক কমরেডের মৃত্যুর বদলা হিসেবে ‘বেলিয়াহাট্টা বন্‌ধ্‌’ না অ্যাক্‌শান স্কোয়াড লাগিয়ে পুলিশ খতম—কোন পথটা ঠিক? ‘সোনা তো বদলার জন্যে লড়েনি, ও লড়েছিল সাচ্চা আজাদির জন্যে।’ এমন তর্ক প্রায়ই ফেনিয়ে ওঠে গোরার বিড়ম্বিত মনে, অসতর্ক জিভের ডগায়। ‘তোর সংগ্রামে মানুষের অস্তিত্ব নেই।’ ‘নাহ্‌ সন্ত্রাসবাদে কোনও কমিউনিস্টের আস্থা থাকে না।’ ‘হয়তো ওর বোঝার ভেতর ফাঁক-ফোকর ছিল। তা ছাড়া, এ এক সূক্ষ্ম শিল্প, নিজের বুঝ আর একজনের কাছে চালান দেওয়া।’ ‘গোরার কেস আরও জটিল (এবার নিজের মনটাকে কাটাছেঁড়া করতে লাগল)। আরও গহেরা।’ সত্যি-মিথ্যে ঠিক-ভুল জরিপ করার আগেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সাঁড়াশি হামলায়, হাজতে-জেলে পাশব নিষ্পেষণে বন্ধ হয়ে যায় নিষ্ক্রমণের সব রাস্তা, ত্রস্ত কোণঠাসা জনবিচ্ছিন্ন গেরিলাদের নেতৃত্বের কাছে এসব প্রশ্ন হয়ে পড়ে অমার্জনীয় ‘শোধনবাদ’ অন্যথা ‘সিপিএমের যুক্তি’, জন্মভূমিকে বাসযোগ্য করার সংরাগকে দেগে দেওয়া হয় পেটি-বুর্জোয়া চিত্তবিলাস ব’লে।

‘জাগরী’ উপন্যাসে রাষ্ট্রের ক্ষমতাতন্ত্রের বিরোধিতার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিল সমাজ-শরীরের সম্বন্ধ—রাজনৈতিক লাইন নিয়ে সপ্রশ্ন দ্বন্দ্বের সঙ্গে অচ্ছেদ্য ছিল জাতপাত, পারিবারিক বিপর্যয় ও বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কালোবাজারি ও ভুখমারি। এই সম্পর্ক তাড়িত করে চারজন কথকের ভাষা, স্মৃতির স্থিতিগতি। স্বগতকথনের মধ্যে দিয়ে সংগঠিত হয় এক দ্বান্দ্বিক সংলাপ, ইতিহাসের আত্মবিনির্মিতি। জেলখানায় শরীরের ভাষার সঙ্গে কথকের চিন্তার ভাষাকে আলাদা করা যায় না আর। পাঠ্যবস্তুর মধ্যে হারায় না ইতিহাস, পাথুরে ইতিহাসকে ব্যক্তির স্মৃতির মারফত নতুন ক’রে পাঠককে অন্যায়ের দুরপনেয় সাক্ষ্যের কথা ভাবতে বাধ্য করে, ভাবতে বাধ্য করে তার নিজের মনন ও কর্মের দায়ের কথা। আত্ম-সর্জনের এমন অধিকার দেয় রাজনৈতিক সাহিত্য; কেবলমাত্র সাহিত্যের এই ভঙ্গুর সৌধেই শহিদের আত্মবিসর্জন অব্যর্থ থেকে যায়। রাঘবের চিন্তাতেও পাঠ্যবস্তুর ঘর-বাহির অবিভাজ্য, অবিভাজ্য ১৯৬৮-র সংক্ষুব্ধ পৃথিবী এবং বেলিয়াহাট্টার অর্ধশিক্ষিত আধপেটা রুগ্ন মজুরদের জেদ ও সোহাগের দুনিয়া। ‘কমুনিস’ উপন্যাসের গদ্য রাজনৈতিক পাঠের পরিভাষার সীমা টেনে দেয় বার বার, রচনা করে তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতার মধ্যে এক সংশয়ী ব্যবধান।

শহিদ ভুল পথে যায়, আন্দোলন ব্যর্থ হয়, রণকৌশল বদলায়। কিন্তু অন্যায় প্রতিহত করার প্রতিটি চেষ্টা ভাষাকে নতুন ইন্ধন জুগিয়ে যায়, নতুন ব্যাখ্যার, নতুন ব্যাখ্যা আদায়ের সংকল্পে ব্যহত করে চিন্তার অভ্যাস, পাঠের অভ্যাস। এ হেন ‘অটো-ক্রিটিক’ ছাড়া, সংশয় বিনা, নিঃসংশয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনও নতুন তাৎপর্য থাকে না—না সাহিত্যের পাঠে, না ইতিহাসের পাঠে।

ইতিহাস সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে যে প্রশ্ন পাঠক তার ঐতিহাসিক স্থানকাল থেকে তাকে করতে পারে। ইতিহাসের সত্য ঠিক কী তবে? রাজনীতির সত্যই বা কী? কোনও সার্বভৌম নিরঙ্কুশ সত্য না-ই বা থাকল, নিয়ন্ত্রক ধারণা হিসেবে সত্যকে অস্বীকার করলে ইতিহাস-রাজনীতিকে অস্বীকার করতে হয়, সত্যযুগের উত্তরপর্বের—অর্থাৎ ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর জমানার—বিকারকে ধ্রুব নিয়তি ব’লে মানতে হয়, খুন করতে হয় যৌথ সাংস্কৃতিক স্মৃতির অস্তিত্বকে। ‘ওয়ান মাস্ট নেভার ডাল দ্য শিয়ার ফোর্স অফ হোয়াট হ্যাপেন্‌ড, দ্য শিয়ার ফোর্স অফ দি ইভেন্টস।’ ১৯৮৮ সালে তাঁর সম্মানে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বলেছিলেন ফরাসি দার্শনিক পোল রিক্যর। এর পরেই তিনি পাড়েন ইহুদিনিধনের প্রসঙ্গ, মানুষের সাম্প্রতিক ইতিহাসে যা একটি নেতিবাচক অর্থে মৌল ঘটনা, ইংরেজি তরজমায় ‘এ নেগেটিভ ফাউন্ডেশনাল ইভেন্ট’। জানতে হবে কী ঘটেছিল, কেমন এমন ঘটেছিল, এর বিহিত কী। মনে রাখতে হবে ‘তাহাদের কথা’। সতীনাথের উপন্যাসের মতোই ‘কমুনিস’ এই মৌলিক প্রশ্নে দীর্ণ, আলোড়িত। অথচ তাজা প্রাণগুলি সেই ফুরসত পেল কোথায়? কেবল হঠকারিতার কথা ব’লে আমরা, আম পাঠকেরা, নিজেদের দায় কতটা এড়াতে পারি? ঈশ্বর সদয় হয়ে আমাদের বিস্মরণশক্তি দিয়েছিলেন হয়তো, ঈশ্বরের প্রবল প্রতিস্পর্ধী রাঘব কিন্তু আমাদের তা দে’ন নি। ‘কেন? কেন ও সব জানল না? রাজনৈতিক পরিভাষার খোলস খান খান করে ভেঙে কেন ও সত্যটা আবিষ্কার করতে পারল না?’ গোরা ভাবছে পুলিশের হাতে অকালমৃত কমরেড সোনার কথা। কিন্তু এই সত্যটা আবিষ্কারের দায় কতটা নিয়েছি আমরা, আমরা যারা নকশাল নিধনের সাফাই উগরে দিয়ে হালকা হই বা বিংশ শতাব্দীর ষাট-সত্তরের ‘পথভ্রষ্ট’ তরুণদের জন্যে শখের শোক করে থাকি। অভ্রান্ত সত্যের দেখা না পেলেও সমাজ-সংসারের ভ্রান্তির মূলের সন্ধান খোলা চোখে করতে চেয়েছি আমাদের মধ্যে কতজন?

এই দেখতে চাওয়া, জানতে চাওয়ার সাহস চারিয়ে দিতে হবে উপন্যাসের গদ্যে, অস্বস্তিকর ভাষার শরীরে। তবেই পাঠ হয়ে উঠবে সত্যিকারের সন্ধান, নিজের অভ্যস্ত বুঝ চলবে হোঁচট খেতে খেতে অনির্দেশ্য সমুখপানে। ‘দুশমনের অত্যাচারে দমছি না, কিন্তু যে যন্তরটা দিয়ে তামাম জনতাকে দাবিয়ে রাখে তার নাট-বল্টু-ইস্ক্রুপ সব দেখে চিনে নিচ্ছি … পরীক্ষা দিচ্ছি … ইনতেহার, সহ্যের আর মনের তাকতের।’ এখানে রাঘবের উপন্যাস সতীনাথের সমধর্মী, যতই তাঁর প্রথম উপন্যাসে কমলকুমারের শৈলীর রেশ দেখা যাক না কেন।

চিত্রগ্রাহক- দিলীপ ব্যানার্জ্জী
ছবি সৌজন্য- তৃতীয় পরিসর
Link…


গুরুচন্ডা৯ – ১৪ নভেম্বর ২০২০

রাঘবসাহিত্য: এক অর্বাচীন পাঠকের জার্নাল : সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

raghab_colour

গল্পে শুনেছি, নচিকেতাকে যখন ‘ধন-রতন’ অফার করলেন যম, নচিকেতা চাইলেন ‘জ্ঞান’! অন্যদিকে ছোটো থেকে বড়ো হতে গিয়ে, ‘ছেলে-ভোলানো’ ছড়ায় শুনলাম, লেখাপড়া (যা-কিনা আমাদের সময়ে অন্তত ‘জ্ঞান’-এর প্রাথমিক উৎস) করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে ওঠা (ভাড়ার ভেবে বসবেন না যেন), তার পক্ষেই সম্ভব হয় কেবল! তাহলে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে নচিকেতার সময় থেকেই ব্যাপারটা খানিক দুয়ে দুয়ে চার হয়ে আছে! সরাসরি টাকাকড়ি না-নিয়ে, নচি হালকা ঘুরপথে ঘটিয়েছিলেন ব্যাপারটা! যাতে করে পরবর্তীকালে যারা আমরা ‘আম-আদমি’, যমের দেখা প্রায়শ পেয়েও, কোনো অফার-টফার পাই না কোনোকালেই, ‘জ্ঞান’-কে ‘ধন’ করে তোলার প্রসেস-পটু হয়ে উঠতে পারি গোড়া থেকেই!

গল্পের কত যে পরত, সত্য সন্ধানে মত্ত মানুষের তা কী আর এক জীবনে বুঝে ওঠা হয় কখনও! নচিকেতার রসিকতায় পাছে কোনো ঘ্যাম-সিরিয়াস পাঠক দেশ-কাল-পাত্রের নিত্য অথবা সত্য বিচারে ব্রতী হয়ে ওঠেন, তাই আগেভাগে গরুকে গাছে তুলে রাখা জরুরি। বলে রাখা জরুরি, এ-লেখায় সামান্যও দায় এবং দায়িত্ব নেই সত্য রক্ষার। সে আপনি পাঠক, আপনিই ভালো জানবেন গল্প আসলে কী, গুজব কারে কয়, প্রকৃষ্ট প্রবন্ধ (আজকের ভাষায় ‘পেপার’) হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্তাবলী, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি জানি লিখলে কথা রবে, কোথাও-না-কোথাও, কালির কলঙ্কে অন্তত, তাই লিখি।

আমি লিখি, আপনি লেখেন, তুমি লেখো, সে লেখে, তিনি লেখেন। সর্বনামের লিঙ্গভেদ নেই, তবে বচনভেদ আছে। তাই আমরা লিখি, আপনারা লেখেন, তোমরা লেখো, তারা লেখে, তাঁরা লেখেন — সবাই লেখে। একইভাবে আমি থেকে সবাই, পড়িও। হালফিলের বাস্তবতা এটাই যে আমরা সবাই লিখি-পড়ি। এই বাস্তবতার বাইরে যেখানে তবুও আছে, রয়ে গেছে খানিক খানিক বিপরীত বাস্তব, লিখিয়ে-পড়িয়ে কিছু করে দেখানোর উদ্যমভুক্ত হতে তারও হয়তো দেরি তেমন নেই আর। থাকবেই বা কেন! আজও যে আছে, সেটাই তো কম লজ্জার কিছু নয়! সবার আগে সকলের জন্য চাই— ‘শিক্ষা’, অর্থাৎ, অক্ষরের অধিকার! কেননা স্বাক্ষরতা ক্রমশ আনে জ্ঞান — জ্ঞান আনে সক্ষমতা — সক্ষমতা আনে উন্নয়ন — আর উন্নয়ন আনে সভ্যতা! এবং যেহেতু যত মত, ততই পথ, আর সব পথ এসে শেষে সেই আমড়াতলার মোড়েই মেলে, বিকল্পের কথা বাড়িয়ে লাভ আছে কি কোনো?

গল্প গরু গাছে পাছে আরও গুলিয়ে ওঠে সবকিছু, মোদ্দাকথাটা এবার পেরে ফেলা যাক তবে। সাড়ে সাতেরোশো থেকে পৌনে তিন হাজার শব্দসীমায় আদতে এ-লেখা তার পাঠককে পা টিপে পড়িয়ে এবং বুঝিয়ে ফেলতে চাইছে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক বাংলা গদ্যকারের সাহিত্যে-সাধন তত্ত্ব! কেন এ-হেন চাওয়া, আর ও তত্ত্ব (তা-ও অন্যের ব্যাখ্যায়) পড়ে প্লাস বুঝে কার কী হবে, সে অবশ্য বাড়তি প্রশ্ন। এমনটাই হয় বলে হচ্ছে এবং হবেও। একেই বলে সাহিত্য-সমালোচনা। অথবা আরও একধাপ এগিয়ে — সমালোচনা-সাহিত্য!

#

ব্যাপার হল গিয়ে রাঘবের সাহিত্যে কী আছে আমি তার কতটুকুই বা জানি! অথবা নিজেকে যদি এমনভাবে বোঝাই যে, আমিই একমাত্র জানি যে রাঘবের সাহিত্যে কী আছে, তারপরও রাঘবের সাহিত্যে যা আছে, তা কিন্তু রাঘবের সাহিত্যেই থেকে যাবে। এ-কথা যে শুধু রাঘবের সাহিত্যের ক্ষেত্রে বলা যায়, তেমন তো নয়। সাহিত্য হোক-না-হোক, যে-কোনো লেখারই তো এটুকুই সম্পর্ক সত্যের সঙ্গে। অক্ষরের মৃতশরীরে অমর হয়ে আছে যে কথাবৃত্তান্ত, পাঠক গিয়ে তাকে কাঠি না-করলে, তার আর সাধ্য কোথায় যে নিজেই জেগে ওঠে! এখন কেউ যদি ভেবে বসেন, এ-লেখার কাজ তাই পাঠককে পটিয়ে হাতে একটা কাঠি তুলে দেওয়া কোনো মতে, রাঘবের সাহিত্যশরীরে তা প্রয়োগ করার জন্য, ভুল করবেন। ও জিনিস পড়া বা না-পড়া আপনার ব্যাপার। আর ও-নিয়ে বুলি কপচানোর কাজ আমার না।

তবে?

মাতৃগর্ভ উৎস ধরে নিলে গন্তব্য মৃত্যুর নিরুদ্দেশলোক, অন্তর্বর্তী যা কিছু তার মধ্যেই থেকে যায় রচনাবৃত্তি, জৈব জীবনকে একটা-না-একটা অর্থ, তাৎপর্য, ব্যঞ্জনামণ্ডিত করে তোলার আকুতি ও প্রয়াস। নগ্ন স্বাধীনতা তার প্রায় জন্ম জড়ুল। দণ্ডিত হয়েও তাই প্রবল উৎসাহে জড়িয়ে পড়ে অন্তহীন সওয়ালে। যন্ত্রণাভিষিক্ত, বৈরি পরিবেশের সঙ্গে নিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত। অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা তাকে ঘিরেই, শিকলের শব্দ যেন তার-ই অস্তিত্বের সংবর্ধনা-বাদ্য। কিছুতেই যে মৃত্যুকে দাসখত লিখে দেবে না, এমন মানুষ দাস হয় কী করে!
— “লিখনদাসের কথা”, ‘দলদাস’

সওয়াল-জবাব-সওয়ালেরা অন্তহীন আবর্তে জড়িয়ে যেতে যেতে, অনিঃশেষ পথের যাত্রী হয়ে উঠলে, জানি না কেন, ক্রমশ বেড়ে ওঠে হামসফরের খোঁজ! বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে একলা চলতে চলতেও হয়তো তাই লিখে রাখতে হয় একলা চলার বয়ান! আয়না অথবা ছায়ার মতো সেই লিখনই তখন হয়ে ওঠে একলা পথের সহযাত্রী, ভাবনা-দোসর! আর ঠিক সেখানেই কি নিজের অজান্তে সংঘটিত হয় কোনো ‘আত্ম’-ঘাতের আয়োজন? নিজের প্রশ্ন, ভাবনাজাল, চিন্তারেখাই হয়ে ওঠে পিছুটান এগিয়ে চলার পথে?

কী হবে এমন হয় যদি, হয়েই চলে নিরন্তর, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পরে একের-পর-এক চিন্তা-কাঠামো হঠাৎ! ভাবনার ভিত যায় কেঁপে! যে লিখন ছায়াসঙ্গীর মতো এতটা পথ একসঙ্গে এল, সে-ই যদি হয়ে ওঠে আমার বর্তমান চিন্তার, অবস্থানের, এমনকি আগামী চলনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী, একাকী ভুলের একমাত্র সাক্ষী! কীভাবে এড়াব তাকে?

এই যে জড়িয়ে যাওয়া অথবা এড়িয়ে চলার বাস্তবতা, যা কম-বেশি প্রায় সকল সচেতন লেখকেরই সংকট, রাঘবেরও হয়তো বা লিখনের ‘জন্ম জড়ুল’! জীবনের প্রতিটা অলগলির গল্প যখনই স্মৃতিকথনের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে, নিতে চায় আত্ম-অনুসন্ধানের এলোমেলো সংরূপ, ‘আত্ম’-কে অনবরত আঘাত করার মাধ্যমেই তখন যেন জন্ম নেয় শব্দ, একের পর এক। আহত, আঘাতপ্রাপ্ত সেই আত্মন — যে তখন নিজেকেও জানে না আর — আদৌ কি প্রস্তাব করে উঠতে পারে কোনো জ্ঞানের অস্তিত্ব বিন্দু? সেই মুক্ত ‘আমি’ তো তখন শুধু পাত্রই নয়, পেরিয়েছে দেশ-কালের সীমানাও!

অথচ যাকে বলছি লিখন, স্ব-ভাবে কেবলই তো বাঁধা পড়তে চাওয়া তার! শব্দ জমে জমে হয়ে উঠতে চায় পাথুরে প্রমাণ — জ্ঞানপ্রস্তর! জ্ঞানের প্রাচীর! এই যে যুগ্ম-বৈপরীত্য, লিখন আর আত্মনের সহাবস্থানে এই যে দুই বিপরীত প্রবণতা, তারই কোনো সমঝোতায়, অথবা অসমীকরণে কি জন্ম নেয় সাহিত্য? জ্ঞানের সঙ্গে কি নিত্য বৈরিতার সম্পর্ক তার? শৃঙ্খলের সম্বন্ধ? যাকে ছিন্ন করার বাসনায়, অস্বীকার করতে করতে, অজানার দিকে এগিয়ে যেতে চাওয়া শুধু?

সে চেয়েছিল চিন্তা করার ক্ষমতাকে আলোর শিখার মতো আগলে রাখতে। ভাবত যে ওই ক্ষমতাই সে। …এই গল্প তাই একদিকে যেমন শেষহীন, তেমনই লিখিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে এর হাজার একটা বয়ান। কান পাতলেই শোনা সম্ভব ভাষার ওই কথন, তার অনুভব — ত্রাস ও মুক্তির তৃষ্ণা। — “বুথ নম্বর : ১৯৪৭”, ‘দলদাস’

#

মগজে কলোনি। গোটা চিন্তাকাঠামোয় যদি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হয়ে চলে ঔপনিবেশিক ঘুণ, হাজার একটা বয়ানও কি তখন পরিগণিত হবে-না, আদতে একই উচ্চারণের বিভিন্ন প্রতিধ্বনিরূপে শুধু! যদি তা-ও হয়, তাতেও কি উদাসীন-ঔদ্ধত্যে আদৌ উপেক্ষা করে ওঠা সম্ভব একের হাজার হয়ে ওঠার কঠোর বাস্তবতা? ক্রমপরিবর্তনশীল চিন্তা-প্রবণতা, কখনও সাময়িক, কখনও-বা সামগ্রিকভাবেই যদি বিভ্রান্তির অভিযোগ আরোপে খারিজ করতে চায় অতীত বাস্তবতা, বাতিল করতে চায় বহুচর্চিত ইতিহাসের বয়ান — অন্তহীনের অভিজ্ঞান, অনিঃশেষের আশ্বাসও তবে তো ঘাঁটি গড়তে শুরু করে সেখানে। কেন্দ্রের বিপরীতে যেতে চেয়ে প্রবল প্রত্যয়ে যখন প্রান্তের পথে পা বাড়ালাম, ভাবিওনি পেরোতে হবে ঠিক কতটা পথ! যখনই ভেবেছি প্রান্তে এসে পৌঁছেছি ঠিক, দেখি কেন্দ্রও সরে এসেছে আমারই পিছু পিছু চুপিসারে! এভাবেই যখন গেছে কেন্দ্র-প্রান্তের জানাটাই আদতে গুলিয়ে, পেয়েছি পথ চলার অনায়াস আনন্দ!

জানার সঙ্গে, জ্ঞানের সঙ্গে আনন্দের যে বোঝাপড়া, ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যেরও খানিক তাই। জানায় আনন্দ আছে, কিন্তু কোনো বিশেষ জানায় থিতু হয়ে থাকলে, আনন্দে ক্রমশ টান পড়তে শুরু করে। ইতিহাস কোনো এক ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি থেকে জানতে, বুঝতে বা ভাবতে চায় ঠিকই, কিন্তু ক্রমশ ওই জানা-বোঝাতেই থিতু হয়ে যাওয়া ব্যতিরেকে, তার আর উপায় থাকে না কোনো। ঔপনিবেশিক নির্মাণের নিকৃষ্ট সব ষড়যন্ত্র থেকে তার নিস্তার প্রায় নেই বললেই চলে। এ-কথা সেই কবেই বুঝেছিলেন বঙ্কিম। বুঝেছেন আধুনিক কালের আরও গুটিকয় ব্যক্তিত্ব। বুঝেছেন রাঘবও। সাহিত্যের পথে তাই নিরন্তর আনন্দের অনুসন্ধান তাঁর, শেকল পরা ইতিহাসের পিছুটান সম্বল করেই।

চিত্রগ্রাহক- অভ্যুদয় মণ্ডল
ছবি সৌজন্য- তৃতীয় পরিসর
Link…


 গুরুচন্ডা৯ – ১৪ নভেম্বর ২০২০

রাঘবসাহিত্য: খোয়াব আর বাস্তবের গল্পভুবন : পারভিন হোসেন

raghab_parveen

“… মনোভাবের অধিকার মনে এবং কালে। মনোভাবের চেষ্টা বহু কাল ধরিয়া বহুমনকে আয়ত্ত করা। এই একান্ত আকাঙ্ক্ষায় কত প্রাচীন কাল ধরিয়া কত ইঙ্গিত, কত ভাষা, কত লিপি, কত পাথরে খোদাই, ধাতুতে ঢালাই, চামড়ায় বাঁধাই, কত গাছের ছালে, পাতায়, কাগজে, কত তুলিতে, খোন্তায়, কলমে, কত আঁকজোক, কত প্রয়াস— বাঁ দিক হইতে ডাহিনে, ডাহিন দিক হইতে বাঁয়ে, উপর হইতে নিচে, এক সার হইতে অন্য সারে। কী? না, আমি যাহা চিন্তা করিয়াছি, তাহা মরিবে না, তাহা মন হইতে মনে, কাল হইতে কালে চিন্তিত হইয়া, অনুভূত হইয়া প্রবাহিত হইয়া চলিবে।” [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

জৈব জীবন, দেহজ যাপনের পরও মানুষের এই থেকে যেতে চাওয়ার আকুতিই উন্মুখ করে তোলে সৃষ্টি-উৎস। নিজেকে প্রকাশ করার, ব্যক্ত করার যে  জন্মজড়ুল নিয়ে পৃথিবীতে আসে মানুষ, সাহিত্য সেই আকুতির বিস্তৃত, মুক্ত প্রাঙ্গণ। জীবনের আচার-নিয়ম, আদব-কায়দায় সীমাবদ্ধ নয় বলেই সাহিত্য প্রতিভাত করে তুলতে চায় আমাদের পারা, না-পারা, পারতে চাওয়াকে। তুলে ধরতে পারে আমাদের হয়ে-ওঠার নীরব ইতিবৃত্ত।

“…আমরা সবাই আক্রান্ত সৃষ্টিব্যাধিতে। মাটির গোপনীয়তায় রসসিঞ্চনে শস্যসৃষ্টি করি আমরা, আমাদের বাঁশিনল গলায়, বাতাসচর্যায়, সুরজন্ম সম্ভব করি, তাকেই আবার আঁচড়ে অক্ষরে ধরি, বর্ণমালা আবিষ্কার করি, তারা পরস্পর মিলেমিশে, সঙ্গত করে শব্দ সম্ভব হয়— যা আমাদের চর্যাপদ, যাতে সৃষ্টি অব্যাহত, প্রাচীন সেই কৌমেরই একজন আমি,…।” [‘বামন অবতার’, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়]

প্রকাশের এই তাড়নাতেই কথা ফুটেছে মানুষের মুখে, তৈরি হয়েছে অক্ষর। শব্দ, বাক্য, যতির ওঠানামায় শরীর পেয়েছে বলতে চাওয়া। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণের বাড়বাড়ন্ত পেরিয়ে ডিজিটাল দুনিয়ার রমরমায় সাহিত্যের মাধ্যম ক্রমপরিবর্তনশীল। প্রকাশের প্লাবনে, জোগানের জোয়ারে সাহিত্যের কাঙ্ক্ষিত চর্যায়, নৈঃশব্দ্য যে কতটুকু বর্তমান, সে নিয়ে প্রশ্ন জাগে। জৈব প্রবৃত্তি, শরীর, শারীরিক জীবনের ঊর্ধ্বে নিজের যে অস্তিত্ব, অনুভবকে সাহিত্যে রেখে যেতে চাওয়া, প্রকাশের সহজলভ্যতা তার বিপরীত কোনো ‘আমিত্ব’- কে প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে ফেলছে কিনা, সে আশঙ্কাও এখন প্রাসঙ্গিক। ‘বাঁশবনে ডোম কানা’-র মতো সাহিত্যের খুল্লা বাজারে পাঠকরাও দিকভ্রান্ত যেন বা। অথচ বিপন্ন এই সময়েও শুধুমাত্র প্রকাশের আত্মিক তাড়নাতেও কোথাও অক্লান্ত থেকেছে কলম। অব্যাহত থেকেছে নৈঃশব্দ্যের প্রবহমান অনুশীলন। অর্থ, যশ, প্রতিপত্তির বাজার-ভুবন, ভোগজীবন, তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ ‘স্বাধীনতা’-র সাইবার নিয়ন্ত্রণেও সাহিত্য তার শিকড় ছড়িয়েছে মাটির আরও গভীরে। গোপন চুপকথার মতো নিঃশব্দে বেড়েছে, তৈরি করেছে সময়ের ভিন্ন আখ্যান, অন্যকথন। সংখ্যার ভোটাভুটি, বাজারের শোরগোল, জনপ্রিয়তার বিজ্ঞাপনের বিপরীতে নিজস্ব ঘরানা ও ভিন্ন শৈলীর নির্মাণ, সেই লেখাকে অভিষিক্ত করেছে স্বতন্ত্র পরিসরে। একইসঙ্গে প্রচলিত প্রবণতা অতিক্রমণের চেষ্টা ও ভিন্ন নৈতিকতার প্রবহমান সৃজন সেই সাহিত্যকে করে তুলেছে রাজনৈতিকও, এবং তাই লাইমলাইটের বাইরে থাকা বিচ্ছিন্ন, একক এই প্রয়াস আমাদের সামনে ভিন্ন জবানকে শুধু তুলে ধরে তাই নয়, সাহিত্যের সম্ভবনা ও সম্যক ইতিহাসকেও যেন আভাসিত করে তোলে। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য এই ভিন্ন এবং বিরল ধারার ঐকান্তিক শরিক।

(২)

বাস্তবের অনুবর্তন ও কল্পনার বুনন বাংলা সাহিত্যে ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, রকমারি রিয়ালিজম প্রভৃতি তত্ত্বের মোড়ক অথবা ঢেউ তার সচেতন প্রভাব ও অন্ধ অনুকরণসহ বাংলা সাহিত্যকে আন্দোলিত করেছে বারবার। বাস্তবের ‘হুবহু’ চিত্রায়ণ-চেষ্টা, তার শোক-দুঃখ, রোজনামচার নিখুঁত বর্ণনান্তে কখনও কালো রাত তো কখনও লাল সূর্যের ভোর যখনই উপচে দিয়েছে একঘেয়েমির ক্লান্তি, অবধারিতভাবে তখন আবার ফিরে এসেছে কল্পনার উদাত্ত, স্বাধীন, বিলাসী বায়বিত বিস্তার। বাস্তব আর কল্পনা, কল্পনা ও বাস্তবের চক্রাকার ঘূর্ণনে দীর্ঘদিন আলোড়িত হয়েছে সাহিত্যভুবন। বৃত্ত বহির্ভূত, ছকভাঙার প্রচেষ্টা যে একদমই ছিল না, তা জোর গলায় বলা না-গেলেও, একথা ঠিক যে সেই প্রয়াস ছিল নিতান্তই ক্ষীণ। অবিনির্মাণের প্রবহমান ভাবনা-চিন্তার অনুশীলন সেই পুনরাবৃত্তির ধারাবাহিক চিত্রকে অনেকাংশে পালটাতে সক্ষম হয়েছে, একথা অস্বীকার করা যায় না।

রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে নিত্য এই ভাঙাগড়ার রূপ দেখতে পাওয়া যায়। ‘বিশ্বভুবন আদতে গল্পভুবন’- গল্পের এই দুনিয়ায় বাস্তবই গল্প, আবার গল্পই সেখানে রূপ নেয় বাস্তবের। অলীক কল্পনাবিলাস নয়, রাঘবের সাহিত্যে বাস্তব তার ঘাম, লালা, থুতু, কাঁচা নর্দমার উপচে ওঠা পাঁকের পচানি গন্ধে সেঁধিয়ে থাকা খোয়াবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, হয়ে ওঠে, বা উঠতে চায়— গল্পশরীর। যেখানে খোয়াব জন্ম নেয় ছেঁড়া কাথাটিতেই, আর বেড়ে চলে লকলক করে। বাস্তব আর কল্পনা বলে বিচ্ছিন্ন করে রাখা এই দুই জিসমের এক জানই রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রাণভোমরা।
“…ক্ষমতা, যশ, প্রতিষ্ঠা যেই অন্যত্র সরে যাবে, ভন্ ভন্ শব্দও পালের বাতাস বুঝে সেইদিকে ছুটবে। প্রভু তখন গমিতমহিমা- এইসবও গল্প, কিন্তু লেখা বেশ কঠিন, লিখতে গেলে সাদা-কালোয় দ্বিভাজিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তো আছেই।”
['দলদাস' 'লিখনদাসের কথা' - রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়]

(৩)

“কল্পনা করা যাক এ রকমই এক নয়, অনেক, যে-কারও সর্বজ্ঞ জিভ এরপর বকতে শুরু করবে, যার মধ্যে সহজ-জটিল, হতাশ ও রোমান্টিক, কপটতা, চালাকি ও নানারকম কারসাজি এবং সময়-বিভ্রাট থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাস করার এক অত্যাশ্চর্য প্রতিভা সমস্ত অবিশ্বাস আর সন্দেহকে একপাশে ঠেলে দেবে। পাঠক-লেখক, শ্রোতা-কথকের এই সমাবেশে সব্বার মত প্রকাশের অধিকার সংরক্ষিত;”

রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাটা জিভের বৃত্তান্ত’-র এই অনন্য উক্তির মধ্যেই তাঁর সমস্ত সাহিত্যসৃষ্টির মূল সুরটি নিহিত। ব্যক্তি, সমাজ, পক্ষের ঘেরাটোপ বিচ্ছিন্ন যেকোনো, যে-কারোর, উন্মুক্ত, বিস্তৃত পরিসরে রাঘবের সাহিত্যের সূচনা। বিচ্ছিন্নতা (সে প্রচলিত প্রথা, শিক্ষা, অভ্যাস যাই হোক) তাঁর সাহিত্যের প্রাথমিক শর্ত হিসাবে কাজ করেছে সবসময়। স্থান-কাল লুপ্ত সেই পরিসরে কথাই শুধু শাশ্বত। যে কারণে নির্দিষ্ট কোনো সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয় রাঘবের লেখনী। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ- এর বিভাজনরেখাও অস্পষ্ট সেখানে। সময়, স্থান, কাল, ব্যক্তি বিশিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন কোনো পরিসরে রাঘবের সাহিত্যের স্থাপনা, ‘মেধাবী ভূত ও মাধবীলতা’য় তা ভূতগ্রাম, ‘কাটা জিভের বৃত্তান্ত’-এ কাটা জিভের অবাধ চরাচর নির্দিষ্ট নামের খোপে আবদ্ধ করে রাখে না তাকে, ‘রক্তজবা রহস্য’-র ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। রাঘবের ছোট গল্পও এর বাইরে নয়।

ভালো ও খারাপ, সাদা এবং কালো এই পাক্ষিক গণ্ডিতে আটকে যাওয়া, নির্দিষ্ট নাম ধাম সময়ের নিক্তি ধরে তৈরি করা সাহিত্যও অমুক যুগ, শতক, শতাব্দীর সাহিত্য লক্ষণে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় বড্ড, সংজ্ঞায়িত হয়ে যায় যেন, সেই কারণেই প্রতি লেখায় নাম, সংজ্ঞা, ছকের গণ্ডি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার, হয়ে চলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা দেখা যায় তাঁর মধ্যে। তবে কি ছক বহির্ভূত, নামবিহীন, সময়স্তব্ধ শূন্য কোনো পরিসর তৈরি করতে চেয়েছিলেন রাঘব? নাকি, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ-বছর-মাস প্রভৃতি খোপে বদ্ধ কথার ভগ্নাংশ কুড়িয়ে, জুড়ে তাকে অসীম, মুক্ত ক্রমনির্মীয়মাণ পরিসরে স্থাপন করেছেন? কথা যেখানে অমর, সম্পৃক্ত, অবিনির্মিত, অনুক্ষণ!

এবং চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা ও অসংলগ্নতা (আয়োজিত) সত্ত্বেও একাত্মতা ও মিলনের অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখা যায় রাঘবের সাহিত্যে। ক্ষমতা, যশ, প্রতিপত্তি, প্রবণতা, স্থান, কাল, সময়, ব্যক্তি এমনকি ‘আমি’ নামক ধারণা থেকেও প্রতিনিয়ত বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়ার যে স্বাক্ষর তাঁর সাহিত্য বহন করে চলে, একইসঙ্গে তার গভীরেই থেকে যায় এই সবকিছুর সঙ্গে তাঁর  নিদারুণ সম্পৃক্তি, বোঝাপড়া, ও জানার ইতিবৃত্ত। এ প্রসঙ্গে ‘রক্তজবা রহস্য’-র শহীদ ক্ষুদিরামের জবানিতে একটি সংলাপ উদ্ধৃত করা যেতে পারে-

“যারা স্বপ্ন দেখেছিল, যারা ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে বড়ো কিছু পরিকল্পনা করেছে এবং তার জন্য জীবনের বাজি ধরেছে, সেক্ষেত্রে একটা বিনিয়োগের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ, বেঁচে থাকাকালীই স্বপ্নপূরণে আমি জীবন উৎসর্গ করেছি। সেই যে উৎসর্গিত জীবন সেটা তো ঘোরতর বাস্তব, সে জড়িয়ে থেকেছে, বেঁচেছে শরীরে নয় স্বপ্নশরীরে। আমি একে স্বপ্নজীবন বলি।… তোমাদের পণ্য সভ্যতার একটা গোড়ার সমস্যা হল এ সম্পূর্ণরূপে স্বপ্নবিরোধী এবং শরীরকেন্দ্রিক। সুখ, আরাম, প্রতিপত্তি, যশ- এর কোনওটাই স্বপ্নভূমির সন্তান নয়। এ হল স্থুল কর্মসূচি। কেবল টার্গেট পূরণের চক্করে ভুলে গেছে কখন অলক্ষ্যে নিজেরাই টার্গেট হয়ে গেছে।”

স্বপ্ন-খোয়াব-বাস্তব  রাঘবের সাহিত্যে সমার্থক। সময়, বিভেদ মুছে যাওয়ায় খোয়াইশ তাঁর গল্পে লেপ্টে থাকে কুৎসিত, কদর্য, নৈঃশব্দ্যের হাত ধরাধরি করে। বাস্তব নামের গণ্ডি সম্পর্কে যা যা চিন্তা-ভাবনায় অভ্যস্ত আমরা, কল্পনা বলতে যে ফ্যান্টাসিতে বিচরণ করি রাঘব এই দুই ক্ষেত্রের মধ্যে ভেদ করেননি কখনও। রাঘবের গল্পে বাস্তব- যা তৈরি করে সেই সম্ভবনা, পরিসর, কল্পনার জন্মের, আবার কল্পনা- যা পেরোতে চায় বাস্তবের না পারা, অক্ষমতা, এই সবকিছু মিলেমিশে অসীম হয়ে উঠেছে। কোনো কাঁটাতারে বাঁধা যায় না যাকে, আটকানো যায় না নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। সর্বোপরি রাঘব কথিত ‘বিশ্বাস করার এক অত্যাশ্চর্য প্রতিভা'(যা পাঠকের কাছ থেকে নিজগুণে আদায় করে নেন তিনি বা তাঁর কথাস্রোত) পূরণ করে দেয় তাঁর সাহিত্যের সমস্ত ফাঁকফোকর যা আদপে জীবনেরই বিচ্যুতি।

(৪)

রাঘবের কথনবিশ্বে শ্রোতা ও পাঠক সবারই মত প্রকাশের অধিকার সংরক্ষিত। ভূতকণ্ঠ বা কোনো সর্বজ্ঞ কাটা জিভের এই কথনে পাঠকের প্রবহমান অনুভূতি ও পরিবর্তমান মতামত মিলেমিশেই যেন তৈরি হয় রাঘবের গল্পভুবন। ‘কাটা জিভের বৃত্তান্ত’-এ যেকোনো কাটা জিভের কথনের মতো নিরপেক্ষ বহু ‘আমি’-র কথন পরিবেশিত হয় রাঘবের সাহিত্যে। বিচ্ছিন্ন যে শূন্য পরিসরে জন্ম নেয় রাঘবের গল্প, পাঠকের উপস্থিতিও সেখানে সংস্কার মুক্ত বায়বীয় শূন্যতা হিসাবেই প্রতিভাত। অসীম সেই নৈঃশব্দ্যে, সময় জ্ঞানহীন, কথালহরে বানভাসি পাঠকও সর্বজ্ঞ, সর্বত্রগামী সেই কাটা জিভ, কথক যেন। যে খোয়াবের জগতকে ভাষায়, অক্ষরে, চিহ্নে আভাসিত করে তুলতে চান রাঘব, পাঠক বা টুকরো টুকরো ‘আমি’ র অনুভব স্পষ্ট করে তোলে সেই স্বপ্নদুনিয়া। কথক, পাঠক ভেদ নেই বলেই রাঘবের কথনবিশ্ব অসংখ্য মতামত, কথা, অনুভব, অনুরাগে ঠাসা তৃতীয় পরিসর যেন। বিচ্ছিন্নতার যে অনুশীলন এক ‘আমি’ র ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে লেখককে অসীম অনুভবের দোরগোড়ায় হাজির করে সেইখানেই শ্রোতা, পাঠক, কথক মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বিচ্ছিন্নতা ও ভিন্নতার ঊর্ধে এখানেই খোয়াব আর বাস্তবের এক হয়ে যাওয়া।

তবে শুধু চিন্তন ও অনুভবের বুননই নয়, প্রকাশের ভঙ্গি, ভাষা, শব্দ প্রতিটি ক্ষেত্রে রাঘব তাকে করে তুলেছেন নৈর্ব্যক্তিক। শুধু তাই নয় সময়জ্ঞানহীন সেই খোয়াব দুনিয়ায় নৈঃশব্দ্যই প্রধান কথক, এবং তাই তাঁর সাহিত্যে ভাষাও নির্দিষ্ট বন্ধন পেরিয়ে বাংলা, হিন্দি, প্রবাদ, প্রবচন, চুটকি, গানের কলি প্রভৃতিকে অনায়াসেই ঠাঁই দিতে পেরেছে নিজ শরীরে। ভাষার এক সম্মিলিত যৌথখামার আমরা দেখতে পাই রাঘবের সাহিত্যে।

(৫)

নিবিড় একাত্মতা ও নিপুণ বিচ্ছিন্নতার আয়োজনের বৈপরীত্য তৈরি করেছে রাঘবের লেখার পটভূমি। কৃপণের মতো কুড়িয়ে এনে উদার হাতে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল বলেই রাঘবের গল্পভুবন এমন স্বতন্ত্র, এমন জীবন্ত৷

“পেশাদার লেখক নই, কিন্তু সাহিত্যের হোলটাইমার অবশ্যই। কোনও কেন্দ্রীয় কমিটির সুপারিশ লাগে না এর জন্য। কর্পোরেটের, অকাদেমির অনুমোদন প্রয়োজন হয়নি। একমাত্র প্রয়োজন অন্যমনস্কতা, খোয়াবের জগৎটিকে কাদায়, নোংরায় আহ্বান করা। চোখের আলোয় কুৎসিতের, অপাংক্তেয়র মুখে ভালোবাসার দরিয়া দর্শন যেন ঘটে। ভাষার ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেও যেন গ্রহণের তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যায়। খিস্তি, হিন্দি গানের কলি, মার্জিত শব্দ হাত ধরাধরি করে চলুক।”
['দলদাস' 'লিখনদাসের কথা' রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়]

বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বপ্নের দুনিয়া নয়, রাঘবের গল্পে খোয়াব কাদায়, নোংরায় মাখামাখি বাস্তব। কুৎসিত, অপাংক্তেয়র মুখে ভালোবাসার দরিয়া দর্শন করার দৃষ্টি, সংলগ্নতা, অনুভব ছিল বলেই কাদা, নোংরা, আবর্জনার মাঝেও খোয়াবের জগতকে অনায়াসে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন তিনি। প্রতিদিনকার অভ্যস্ত, মুখস্তপ্রায় জীবনের চেনা সুখ, চেনা দুঃখ, পরিচিত গাঁটের ব্যথা, আরও চেনা বিরক্তি, প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হলে ঠোঁটে আলতো করে ঝুলিয়ে দেওয়া মেকি হাসি, শীতের জলধোয়া চামড়ার ভোঁতা স্পর্শের মতো অনুভূত হওয়া সত্ত্বেও জীবনের যে কামনা, হতে চাওয়া, হয়ে ওঠার চেষ্টা জীবনকে জীবন করে তোলে, আলাদা করে তোলে প্রতিটা দিনকে, সহনীয় করে তোলে, সহজ বলে মেলে ধরে, এবং তারই সঙ্গে গোপনে ছড়িয়ে চলে স্বপ্নবীজ, মুছে চলে সব বিভেদরেখা, সুপ্ত সেই জীবনের অজস্র সূক্ষ্ম তন্তুর মরমী বুনন রাঘবের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে চলে। আর তাই রাঘবের সাহিত্য একই সঙ্গে যেমন অসমাপ্ত তেমনি চিরনির্মীয়মাণ।

চিত্রগ্রাহক- অভ্যুদয় মণ্ডল
ছবি সৌজন্য- তৃতীয় পরিসর
Link…


আনন্দবাজার পুস্তক পরিচয়, ২ জুন, ২০১৯


Book Review[ ... LINK ]


এই সময়, ৫ এপ্রিল, ২০১৭
eisamay_raghab987

Link to Ei Samay article …

 


এই সময়, ৪ এপ্রিল, ২০১৭
ei_samay_press_club

Link to Ei Samay article …

 


FRONTIER Vol. 49, No.38, Mar 26 – April 1, 2017

Raghab Bandyopadhyay (1946-2017)
– Jogia Bandyopadhyay

Raghab Bandyopadhyay passed away on February 8, 2017. He was born on 14th November, 1946. Brought up in Kolkata, he came in touch with rural Bengal in the late sixties by virtue of his close association with the Naxal Movement. It was around this time that he started writing for little magazines. Following his arrest in 1970, Raghab spent three years as a prisoner of the State. Once he described himself as a student of Presidency Jail.

His years as a political activist and subsequently a political prisoner found expression in his debut literary work “Akaalbodhan o Anyanyo Galpa” (a collection of short stories published in 1974). Subsequently the publication of his debut novel “Komunis” in 1978 met with extremely encouraging and enthusiastic response from intellectuals like Ranajit Guha (renowned historian), poet Shankha Ghosh, the late Ashok Rudra (eminent economist, social scientist and scholar) and Malini Bhattacharya (former Professor of English, Jadavpur University and former Director of School of Women’s Studies). The late seventies and early eighties saw the publication of some other literary works by Raghab such as a collection of short stories called “Baadar Galpa” and his second novel “Shaishab”. During this time Raghab also began his professional career as a journalist at the invitation of the editor of Aajkal, the late Gour Kishore Ghosh, a renowned author and journalist. Later, in the mid-eighties, he joined Anandabazar Patrika.Raghab’s literary journey then continued alongside his professional career, yielding non-fiction stemming from his journalistic experience like “Anya Kolkata” and “Baanglaar Mukh” as well as fiction like “Angshagrahan”, “Aashmaani Kathaa : Uchchheder Panch Kahan”, “Galpa 33″, “Jarnal Sattar” and “Satik Jadunagar”, all of which earned critical acclaim. A completely different kind of research-based project that he undertook and accomplished in 2005 was the book “Kamalkumaar, Kalkaataa Pichhutaaner Itihaas”. This was published as the ninth book of a series called “Itihaas Granthamaalaa”, brought, out by Ananda Publishers.

After his retirement from Anandabazar Patrika, Raghab brought into being a publishing house called Charchapada in 2008. In a relatively short time since its inception Charchapada was able to establish its own unique identity through the publication of a number of critically acclaimed Bengali titles. Even while he was nurturing Charchapada, most of Raghab’s time was still consumed by his own writing. He wrote three novels, “Chor Challisha”, “Medhabibhut o Madhabilata” and “Operation Rajarhaat” during the period 2010-2013. “Kathak”, a Bengali little magazine, published a special issue in 2012, dedicated to this unique author, which had contributions from eminent contemporary Bengali writers like Debesh Roy and Nabarun Bhattacharya as well as academicians/scholars such as Ashoke Sen, Sudhir Chakrabarty and Swapan Chakrabarty. In the same year Raghab was also invited to the 3rd Norman Cutler Conference on South Asian Literature at University of Chicago as a featured author.

Raghab’s literary corpus, consisting of about seventy short stories, three novellas and eight novels, while not bountiful, sparkles with creativity and variety, containing many experiments with narrative form and the use of language. Raghab’s own political and journalistic experiences had a profound impact on the themes of his literary works. One hears a chorus of many voices in his works, yet the dominant tone is unfailingly that of the displaced and marginalized. He presents a landscape of desolation over which wisps of dreams hover. Dreams that are frail yet tenacious. Dreams that have lives of their own.

The year 2015 saw the fruition of Raghab’s most ambitious literary project “Kaataa Jibher Brittaanta : Chandanaa Daaini o Jaadubaati”. Unfortunately this year also brought the fatal diagnosis of a metastatic cancer. His last book of short stories “Daladaas” was published in 2016. Towards the end of 2016 he completed, his last novel “Raktajabaa Rahasya”, which was published in January, 2017.

Meanwhile, a number of vernacular dailies have published critical reviews of his last novel to pay tribute to this departed soul who chose to break with the past and show the literary world something new.

Link to Frontier article …

 


দ্য নিউজ, ৮ মার্চ, ২০১৭  

thenews1
thenews2
thenews3

Link to The News article …

 


আনন্দবাজার, ১০ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০১৭

raghab3

Link to Anandabazar article …

 


এই সময়, ৯ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০১৭

raghab1

Link to Ei Samay article …

 


আজকাল, ৯ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০১৭

raghab31

Link to Aajkaal article …

 


epw

epw2

epw3

Link to EPW article …

 


raktabjaba1

raktabjaba2

raktabjaba3

raktabjaba4

raktabjaba5

Link to Anandabazar article …

 


একদিন, ৪ অক্টোবর, ২০১১

raghab